Monday, December 24, 2007

এরাও যিশু


আজ যিশুর জন্মদিন, ঘরে ঘরে উৎসব,

তার মাঝে জন্ম নিলো কয়েক শত যিশু;


কাউকে আস্তাকুড়ে ফেলে এলো কুমারি মা

কেউ হলো অবাঞ্ছিত,কারণ তারা মেয়ে শিশু!

কেউ জন্মেই হাত বদল টাকার বিনিময়ে,

কেউ ভাড়া হোয়ে ঘোরে রোদে ভিখিরির কাঁখে;

কারোর হাতে পড়লো কড়া বারুদ ঠেসে ঠেসে,

কেউ হোয়ে রেসের “জকি” ঊটকে আঁকড়ে থাকে।

মেরী মায়ের স্নেহের আঁচল ঢাকলো না মাথা,

পেলো না মমতার আলিঙ্গন,জিরোলো না কোলে।

অন্ধকারের পেরেক ঠুকে ভবিষ্যতের হাতে,

চেয়ে দেখো! হাজার যিশু ক্রুশের ‘পরে ঝোলে।

Sunday, December 23, 2007

ওরাই কাজ করে




আমার এক রাঙ্গামামা, জ্ঞ্যনীগুণী লোক,
আজীবন তাঁর শুধু পড়াতেই ঝোঁক।
মামির কাঁধেতে দিয়ে সংসার ভার,
সময়টা কাটে শুধু লিখে পড়ে তাঁর।
মামি বলে,”চলো না গো, ঘুরে আসি পুরি,”
মামা বলে,”না না, কাজ আছে ঝুরি ঝুরি।
তোমার তো খৈ ভাজা, কাজ কোনো নেই,
তাইতো বেড়াবো বলে নাচো ধেই ধেই”।
মামি দিয়ে গালে হাত, বলে,”ও মা সেকি!
লেখা পড়া কাজ শুধু, বাকি সব মেকি?
ভোর পাঁচটার থেকে শুরু হয় বওয়া
সংসার বোঝা, আছে রাঁধা, বাড়া, খাওয়া।
হয়েছো বাজার মুখো? চেনো রুই কই?
পিঁয়াজের কিলো কত? মাংস বা দৈ?
কুচোদের লেখাপড়া থেকে ছবি আঁকা
কিম্বা রাতবিরেতে ডাক্তার ডাকা--!
সামলেছি একা হাতে ছেলেদের বিয়ে,
কেনাকাটা, কেটারিং, তত্ত্ব সাজিয়ে।
তুমি শুধু সেজে গুজে হাতে নিয়ে কোঁচা
গেস্টের আগে খেতে চলে গেলে সোজা;
চিন্তাবিহীন হোয়ে ঢোকো পড়া ঘরে,
টাইমে হাজির চা-টা টেবিলের উপরে--।
দিচ্ছি তোমায় আমি একটা চ্যালেঞ্জ,
একদিন করে দেখো রোল এক্সচেঞ্জ।
আমি হয়ে কেজোবাবু লেখা পড়া করি,
তুমি রাঁধো, বাড়ো সেজে অকাজের ধারি।
“কাজের” সংজ্ঞা যদি বদলাতে পারো,
পুরীতে ঘুরিয়ে এনো দিন দশ বারো।

Tuesday, November 27, 2007

নানা রঙের বৃষ্টি


সাদা

মুখার্জি বাড়ির ৬ বছরের রাজর্ষি, ওরফে ঋষি, তাদের বিশাল বাড়ির ততোধিক বিশাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঘন কালো মেঘের ফাঁকে বিদ্যুতের চমক দেখতে দেখতে, তার সুন্দর কচি মুখখানাতেও একটুকরো নির্মল হাসির ঝিলিক খেলে গেলো। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া আসন্ন বৃষ্টির বার্তা বয়ে আনলো। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হতেই সে দৌড়ে নিচে নামতে নামতে বলল,”মা, আমি বৃষ্টিতে ভিজবো, খুব মজা হবে”।

মণিকা রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসে ছেলেকে আটকানোর চেষ্টা করলেন। অনেক কাকুতি মিনতি করে বললেন,” বৃষ্টিতে ভিজিস না বাবা, জ্বর হয়ে যেতে পারে, জ্বর হলে ইস্কুল কামাই হবে, বিচ্ছিরি বার্লি খেতে হবে, খেলতেও পারবি না”। যখন দেখলেন নাছোড়বান্দা ছেলেকে কিছুতেই মানানো যাচ্ছে না, তখন শোবার ঘর থেকে একখানা বড় মাপের টার্কিশ তোয়ালে আর একজোড়া জামা প্যান্ট নিয়ে ওর পিছন পিছন ছুটলেন।

প্রচন্ড গরমের পর প্রথম বৃষ্টির স্নিগ্ধ ধারায় ভিজতে ভিজতে ঋষি হাততালি দিয়ে নাচতে লাগলো। উল্লাসে চিৎকার করতে করতে হাতদুটো প্রজাপতির মত মেলে দিয়ে বাগানে এ গাছ থেকে ও গাছ ছুটে বেড়ালো। প্রবল বর্ষন যখন ওর জামাকাপড় সপসপে ভিজিয়ে তুললো, মণিকা অনেক বুঝিয়ে ছেলেকে ঢাকা বারান্দায় নিয়ে এলেন। বৃষ্টিতে তাঁরও ভিজতে খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ছেলের কথা ভেবে ইচ্ছেটাকে দমন করে নিলেন। উনি ভিজলে ছেলেকে কিছুতেই থামানো যাবে না। তারপর যদি অসুখ বাঁধিয়ে বসে! একমাত্র পুত্রের চিন্তায় উনি সর্ব্বদা তটস্থ হয়ে থাকেন।

জামা ছাড়িয়ে, নরম তোয়ালেতে ঋষির গা মুছতে মুছতে মণিকা গেয়ে উঠলেন --- পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন নেচে ওঠে ---। ঋষিও তার কচি সুরেলা গলায় মায়ের সাথে যোগ দিলো। শুকনো জামা পরে ঋষি ভিতর থেকে কাগজ জোগাড় করে নিয়ে এল। মা ছেলেতে মিলে কত যে নৌকো বানানো হোল আর সিড়ির নিচে জমে থাকা জলে ভাসানো হোল তার হিসেব নেই। বৃষ্টির ধারার সাথে এক নির্মল আনন্দের ধারা দুজনকে সিক্ত করে তুললো।

চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎ আর কাছাকাছি কোথাও প্রচন্ড জোরে বাজ পড়ার আওয়াজ শুনে মনিকা ছেলেকে বাড়ির ভিতরে এনে দরজা বন্ধ ক্করে দিলেন। রাঁধুনিকে ডেকে বললেন খিচুড়ি রান্না করতে, তার সাথে কুরকুরে আলু ভাজা আর ডিম ভাজা, ঋষি বাবুর বড় প্রিয়।


কালো

পচা ফুটপাতে থাকে। ওর বাবা মা কোথায় থাকে, বা আদৌ আছে কিনা ওর জানা নেই। বয়স বছর আষ্টেক হবে, দেখতে আরও ছোট লাগে। কালু নামের ঘেয়ো কুকুরটা পচার সর্ব্বক্ষনের সঙ্গি। পচা, ওরই মত আরও গুটিকতক ছেলে মেয়েদের সাথে সারাদিন কাগজ কুড়োয়, আর দিনের শেষে সেগুলো বিক্কিরি করে। তাতে অবশ্য দু বেলা পেট পুরে খাবার মত কিছুই জোটে না। মোড়ের চায়ের দোকানের হাবু মাঝে মধ্যে দু একখানা নেড়ি বিস্কুট খেতে দেয় তাকে। কখনও সে মন্দিরের সামনে লাইনে বসে পড়ে মানত উজ্জাপনের খাবার খেতে। কালু, পচার সঙ্গ কখনও ছাড়ে না। পচার যা জোটে, কালুও তার ভাগ অবশ্যই পায়।

উপচে পড়া ডাস্টবিন থেকে কাগজের টুকড়ো কুড়োতে কুড়োতে পচা আকাশের দিকে চাইলো। ঘন কালো মেঘের ফাঁকে বিদ্যুতের ঝিলিক তার রোদে পোড়া নোংরা মুখে একটুকরো হাসির আভাস এনে দিল। প্রচন্ড গরমের পর বৃষ্টি নামছে, একটু ঠান্ডা হবে। পরক্ষনেই সে দৃষ্টি নামিয়ে ক্ষিপ্র হাতে কাগজ বাছাইয়ের কাজে মন দিলো। বৃষ্টি নামার আগে যতটা পারে সংগ্রহ করে নিতে হবে।

দেখতে দেখতে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। পচা বস্তাটা পিঠে নিয়ে ছুট্টে গিয়ে একটা দোকানের ছাউনির তলায় আশ্রয় নিলো। কিন্তু ওর আট বছরের চঞ্চল মন চাইছে বৃষ্টিতে ভিজতে, খুব ভিজতে। বস্তাটা সেখানেই নামিয়ে, এক ছুট্টে রাস্তায় নেমে মুখটা আকাশের দিকে তুলে প্রথমে কিছুক্ষন অঝর ধারার নিচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর শুরু হোল তার উদ্দাম নাচ। হাত দুটো ছড়িয়ে দিয়ে এ ফুটপাত থেকে ও ফুটপাত, যেন এক খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া পাখি। নাচের সাথে চলতে লগলো ঊচ্চস্বরে হিন্দি ছবির গান। তাকে দেখে আশ্রয় নেওয়া পথচারিদের মুখেও তাদের অজান্তে হাসি ফুটে উঠলো।


পচা বৃষ্টিতে ভিজেই চলেছে, তাকে যে মানা করার কেউ নেই! নেই বললেই কী চলে? হঠাৎ তার চোখে পড়ে, কাগজে ভরা বস্তাটা লোকের পায় পায় রাস্তায় পড়ে গেছে। কাগজগুলো কাদাজলে মাখামাখি। আজ আর রোজগারের কোনও আশা রইলো না! কথাটা খেয়াল হতেই শীতটা টের পেলো পচা। ভিজে শরিরটা তির তির করে কাঁপতে লাগলো। ছাউনির নিচে ফিরে এসে, কালুকে জড়িয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ভিজে হাওয়ায় তার শরীরের জল শুকোবে। আজ যে ওর কাছে এক পয়সাও নেই; যদি চায়ের দোকানের হাবু তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে চলে যায়? কথাটা ভাবতেই পেটের ভিতর ক্ষিদেটা মোচর দিয়ে উঠলো। বৃষ্টি দেখে এখন সে আর হাসছে না। আট বছরের কচি মুখে বেমানান চিন্তার রেখা। কালুকে জড়িয়ে ধরে শুকনো মুখে শুধু বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষা করছে।


রানু




বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের জটলার ফাঁক দিয়ে একফালি সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কিছুটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া আকাশে অর্দ্ধবৃত্ত্বাকার এক রামধনু, যেন স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর সপ্তরঙ্গা রথে চড়ে মর্তবাসিদের কাছে প্রকট হয়েছেন।

ঋষি তাদের প্রশস্ত ছাদে উঠে এসেছে রামধনু দেখবে বলে। মা, ঠাকুমা দুদিক থেকে জড়িয়ে আছেন ওকে। সে তার সুন্দর চোখদুটো আরও বড় করে অবাক বিস্ময়ে রামধনুর অত্যাশ্চর্য্য রূপ দেখছে। মা তাকে রামধনুর সাতটি রঙের বর্ণনা দিচ্ছেন আর ঠাকুমা শোনাচ্ছেন রামধনু নিয়ে রুপকথার গল্প। ওর কচি মনটা উড়তে উড়তে হারিয়ে গেল মেঘের ফাঁকে রামধনুর ওই রঙ্গেদের মাঝে।

পচা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, অবাক বিস্ময়ে রামধনুর দিকে চেয়ে আছে। আকাশে এমন অদ্ভুত সুন্দর রঙের খেলা সে আগে কোনদিনও দেখে নি। ওর কচি মনটা ক্ষিদে তেষ্টা ভুলে উড়তে উড়তে হারিয়ে গেল রামধনুর ওই রঙ্গেদের দেশে। পায়ের সাথে লেপ্টে থাকা কালুকে বললো,”এই কালু, তাকিয়ে দেখ, কী সুন্দর! ওটা কী রে?”উত্তরে কালু তার ঘেয়ো কানটা সজোরে চুলকাতে লাগলো।

রামধনু, তার সাতটা রঙের ছটা ঋষি আর পচার চোখে ছড়িয়ে দিল। ওরা দুজনেই স্বপ্ন দেখবে, সাদা কালোয়ে নয়...রঙ্গিন, সাত রঙ্গে রাঙ্গা।

যাযাবর


আমাকে বলা হয়েছে “যাযাবর” বিষয়টি নিয়ে গল্প লিখতে।যাযাবরের সঞা ছাড়া আর কিছুই যে মাথায় আসছে না! ভগবানের দেওয়া বুদ্ধি নামক জিনিষটিকে নানান দিশায় দৌড় করিয়েও কোনও লক্ষে পৌঁছাতে পারছি না, কেবল কলম চিবিয়ে যাচ্ছি।

বলাই বাহুল্য, ভাবনার জট খুলতে গিয়ে বার বার গৃহকর্মের নৈপূণ্যে বাঁধা পড়ছে। ব্যাঞ্জনগুলি হয় আলুনি নয় অতিলুনি হয়ে পরিবেষিত হচ্ছে। আমার অসামান্য ধৈর্য্যশীল স্বামী বিনা বাক্যব্যায়ে এই অত্যাচার সহ্য করে চলেছেন।

আমি ঠিক করেছি, চুলোয় যাক যাযাবর! আজ কষিয়ে পোলাউ মাংস রান্না কোরে এ কদিনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো। বাজার থেকে মাংস আনার অনুরোধ শুনে উনি এমন ভাবে ভুরুজোড়া নাচালেন যে আমি গেলাম বেজায় ক্ষেপে।বললাম,”আজ নুন বেশী হবে না, হলুদ দিতে ভুলবো না, অন্যমনষ্ক হয়ে দুবার জল ঢেলে ফেলবো না।“উনি একটা ছোট্ট “আমি কী তাই বোলেছি”গোছের মুচকি হেঁসে থলিটা নিয়ে প্রস্থান করলেন।

বেশ মন দিয়ে মাংসটা কষছি, এমন সময় কে যেন বলে উঠল,”তুমি কে?”নিশ্চই সেই “অন্তরাত্মা বেটা”; আমি লক্ষ করেছি, যখনই আমি একান্তে কিছু করতে চাই, বেটা খোঁচা দেবেই দেবে।আবার আওয়াজ এল,”তুমি কে?”আমিও বা কিসে কম যাই? খুন্তিটা তালে তালে নাড়াতে নাড়াতে গান ধরলাম...”আমি এক যাযাবর; পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর, তাই আমি যাযাবর”।

খুন্তি নাড়া থেমে গেল, গানের সুর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সে ফিস ফিস করে বলে উঠলো,”মিছেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলে, পেলে তো যাযাবরকে?” মনটা ছুট্টে চলে গেল আমার সেই ১০ বছর বয়সে, যখন থেকে আমার “যাযাবরের” জীবন শুরু......

বাবার বদলির চাকরি।৩ বছর অন্তর এক শহর থেকে অন্য শহর। ট্রাকে সংসার চাপিয়ে দিয়ে ট্রেনে করে অন্য এক শহরে পৌঁছে যাওয়া। ভিন্ন লোকের সাথে মেশা, তাদের ভাষা শেখার চেষ্টা, তাদের সংষ্কৃতির কিছুটা গ্রহণ কিছুটা অবঞা। কোথাও পাহাড়ের ফাঁকে সূর্য্যাস্ত, পাহাড়ী নদীতে পা ডুবিয়ে রবিন্দ্রসংগীত গাওয়া, ফেউয়ের ডাক,পাড়ায়ে পথ হারিয়ে ফেলা ভাঘের ছানাদের খেলা। কখনও বা সমূদ্রে তটে বসে ঢেউ গোনা, অচীন ভাষা শেখার আপ্রাণ চেষ্টা, তাদের নাচ
দেখে অনুপ্রেরিতো হওয়া। কিম্বা, পড়সীর কাছে শেখা ইডলি, দোসা রান্না কোরে মায়ের তাক লাগিয়ে দেওয়া!




যাযাবরের মতই রঙ্গিন লাগতো জীবনটাকে। একই জায়গায় বছরের পর বছর কাটানোর একঘেয়েমি নেই, নতুন বন্ধুত্বের হাতছানি, নতুন রূপে নতুন দেশ দেখার নেশা, এই সবই আমার ব্যক্তিত্ত্বকে, আমার চিন্তাশক্তিকে নতুনভাবে অনুপ্রেরণা দিতো। দু বছর কাটতে না কাটতেই বাবাকে তাড়া দিতাম, জানতে চাইতাম, এবার কোথায়?

প্রকৃতির নিয়মেই হয়তো, “যাযাবর দুহিতা” একদিন “যাযাবর ভার্য্যা”হয়ে গেলেন। বাবার হাত ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। এই যাত্রায় পেলাম রাজস্থানের “ঘুমার নাচের” সাথে মুখরোচক “দাল বাটি চুর্মা”, গুজরাটের “ডাণ্ডিয়ার” সাথে“পাত্রার”স্বাদ। কেবল ভারতবর্ষ নয়, পৃথবীর ডাকে সাড়া দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম সংসার গুটিয়ে, কাটিয়ে দিলাম দীর্ঘ ৩০ বছর বিদেশের বিভিন্ন শহরে। শিখলাম তাদের ভাষা, গ্রহণ করলাম তাদের সংষ্কৃতীর ভাল অংশটুকু।

আমাদের পরের প্রজন্মদের আমি উপাধি দিয়েছি “খান্দানী যাযাবর”। যাযাবরের রক্ত বংশানুক্রমে এখন তাদের ধমনীতে বইছে। এরা হয়তো প্রকৃত যাযাবরের মতই “ভুলবে নিজের ঘর”!সমস্ত পৃথিবী যাদের ঘর, ভারতবর্ষের মানচিত্রে, পশ্চিমবাংলার একটা ছোট্ট গ্রামের কথা তাদের কী আর মনে থাকবে?

আমরা কিন্তু ভুলতে পারিনি। জীবনের এতগুলো বছর ভবঘুরে হয়েও, শেষ অধ্যায় পৌঁছে, শিকড়ের টানে এসে থিতু হয়েছি এই গ্রাম বাংলায়।

হঠাৎ পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। গল্প লেখার মশলা যোগাড় করতে গিয়ে দেখি মাংসের মশলা পুড়ে ছাড়খাড়।


আর্য অনার্য

বাবরি চুলের দ্রাবিড় রাজা
মুষ্কো কালো ষণ্ডা
মন্ত্রীকে সে হুকুম করে
পাঠাও দূত একগণ্ডা
হদিশ আনুক ফর্সা বিবির
আলতা দুধে রঙ
পটল চেরা চোখ হবে তার
মিষ্টি কথার ঢং
মন্ত্রী বলে চুলকে মাথা
শুভ্র যেমন ইডলী?
তেমন বিবির খোঁজটি হুজুর
পাবেন সুদূর দিল্লী
কিন্তু ওদের পোষাক, ভাষা
এক্কেবারে ভিন্ন
দক্ষিণ আর উত্তর দিক
বড্ড সে বিচ্ছিন্ন
তাই না শুনে কেলটে রাজা
জুড়লো বিকট কান্না
ঠিক তখনই ছিলেন পূজোয়
রাজার আপন আন্না
আন্না হোয়েও হন নি রাজা
ব্রহ্মচারী তিনি
কাটবে জীবন দেব দ্বিজেতে
পণ নিয়েছেন ইনি
কান্না শুনেই ছুট্টে এসে
চোখদুটি দেন মুছে
বললেন ভাই লক্ষ্মী কানাই
আনিস বিবি বুঝে
ফর্সা বিবির নখরা অনেক
দ্রাবিড় ভাষায় অবোধ
হিন্দী কথার কচকচানি
বুঝবি না নির্বোধ
পারবে কী সে রাঁধতে রসম
ইডলি, বড়া, দোসা?
রোজ না পেলে রাজমা চাওয়াল
করবে বড়ই গোসা
কর্ণাটকি রাগ- নর্ত্তন
বুঝবে না সে মোটে
গিদ্ধা লুড়ি ভাংড়া ঝুমার
নাচের মজা লোটে
দ্রাবিড় দেশের সুন্দরীদের
বিশ্বভূবন চর্চ্চা
কালো রূপের আলোই করে
উজ্জ্বল সাজ-সজ্জা
তাই তো বলি রাজন ও ভাই
দ্রাবিড় বিবিই ভাল
একই ভাষায় আলাপ বিলাপ
হোক না যতই কালো



দন্তরুচি কৌমুদী







খাচ্ছে বুড়ো দত্ত খুড়ো মাংসওয়ালা হাড়,
চোখটি বুজে ঘাড়টি গুঁজে শক্ত হাতে তার।
হায় রে এ কী? হঠাৎ দেখি ছিটকে খুড়ির পাতে --
দুখান খাঁটি দাঁতের পাটি পড়ল মাখা ভাতে।
মাতিয়ে পাড়া জাগিয়ে সাড়া গিন্নি জোড়েন কান্না,
চাপড়ে কপাল বলেন গোপাল বুড়োর সাথে আ--ন্না!
নকল দাঁতে হাড় চিবাতে সখটি তাহার বল ক্যান?
মটন কারি ভর্তি হাঁড়ি না হলে রোজ ঘ্যান ঘ্যান!
নকল দেঁতে মাংস খেতে পিত্তি জ্বলে দেখে --
তাই না শুনে তেল বেগুনে বুড়োও বলেন হেঁকে,
যতই কাঁদস তুই কী রাঁধোস খবর কী কেউ রাখে?
দেখ নিয়ে খোঁজ খায় কী না রোজ একজনও তা লাখে?
মাংস রেঁধে আনিস সেধে সোঁদর বনের রাক্ষস,
বাজবে তারও দাঁতের বারো,নকলি দাঁতের কী দোষ?

Wednesday, October 3, 2007

মা



শিশুর জন্মক্ষনে মায়ের জন্ম হয়,
প্রসবের যন্ত্রনা,কান্না কষ্ট ভয়-
কচি মুখ দেখলেই সে সব হয় তুচ্ছ্‌,
ছোট এক মাথাভরা রেশম গুচ্ছ।

মায়ের জুড়ে ওই একরত্তি,
আবদার বা বায়নায় নেই কোনো আপত্তি।
টোলখাওয়া হাসি মুখ দেখে প্রাণ হাসে,
কান্না শুনলেই বুক কাঁপে ভয় ত্রাসে।

মায়েরই হাতটা ধরে হাঁটতে শেখা,
কিম্বা সেলেটে অ আ ক খ লেখা।
ভুতের গল্প শুনে ভয় পেয়ে সোজা,
মায়ের বুকেতে থাকে মুখ তার গোঁজা।

যত রাগ অভিমান মায়েরই সাথে,
তবু খাওয়া চাই ভাত মায়ের পাতে।
সময়ে শিশু থেকে কৈশোরে পা,
খেলাধুলা, বন্ধু, পড়া সিনেমা।

মেয়েও বড় হয় দাদারই মত,
লেখাপড়া গান গাওয়া কাজ তার শত।
ব্যস্ত সবাই বড় দেখা পাওয়া ভার,
সারাদিন কাটায় তারা যার ঘরে তার।

সাবালক ছেলে মেয়ে যায় বাড়ি ছেড়ে,
কোথা থেকে শুণ্যতা আসে তেড়ে।
দায়ের হাড়িকাঠে দিয়েছে বলি,
ছবি আঁকা লেখা আর গান কীটস শেলি।

শখ আলহাদ মুছে গেছে ধীরে ধীরে,
কেটেছে প্রতিটিক্ষণ এদের ঘিরে।
শিখেছিলো নাচ গান পিয়ানো আঁকা,
লেখাতেও হাত ছিল নেহাত পাকা।

আজ বসে একমনে জানালার ধারে,
তানপুরাটায় চোখ তার যায় বারে বারে।
ভাবে,দেখি চেষ্টা ক’রে আরেকবার!
ধুলো ঝেড়ে খাতা বই,তানপুরা তার।

মায়ের খোলস থেকে বেরিয়ে “আমি”,
শুরু করে ছিল যা সবচেয়ে দামী।
গান গায়, ছন্দে লেখে, ছবিও আঁকে,
পূর্ণতায় তার সকল শুণ্যতা ঢাকে।

সমর্পণ


যেদিন তাঁর বিয়ে হয়
নতুন করে সে জন্মায়
শরীর মন আত্মা
নিজস্ব সব সত্তা
সুখ দুঃখ লজ্জা ভয়
স্বামীর চরণে স্থান পায়

স্বামী ধ্যান স্বামী জ্ঞ্যান
অস্তিত্ব জুড়ে শুধু “উনি”
তাঁর এই নিবেদিত মনে
সন্তান কী আছে এক কোনে?
ভয় হয় পাছে তিনি
পুত্র স্নেহে ভেসে যান!

রাখেনি তাই তাকে কাছে
“ওঁর” যত্নের হবে ত্রুটি
নিবি ষ্ট মনে শুধু সেবা
এমনটি আর দেখেছে কে বা
যেন শিব পার্বতীর জুটি
হার মানে এঁদের কাছে

৬৫ বছর কেবল শুনেছেন
করেছেন শুধু “উনি” যা চান
নিজস্ব মত সখ আবদার
ছিঁড়ে করেছেন ছাড়খাড়
“ওঁর” মানেই আমার মান
এইটুকুই শুধু বুঝেছেন

আজ তিনি শয্যাগত
মৃত্যুর সাথে চলছে লড়াই
অবশ দেহ সচেতন মন
চোখ দুটো শুধু খোঁজে একজন
তিনি না দিলে অন্তিম রায়
মৃত্যুও হবে আশাহত

বোবা চোখ দুটি করে প্রতীক্ষা
অকাতরে চান অন্তিম ভিক্ষা
স্বামীর মুখের একটি বাণী
যাও তুমি, আদেশ মানি
মুক্ত হোক তোমার সত্তা
মুক্ত হোক তোমার আত্মা

একলা চল


লালচে ভোর হলদে দুফুর
নীলচে বিকেল কালচে রাত
সবই সমান এঁদের কাছে
আশীতি এই বৃদ্ধ জাত

লাঠির ভরে হোঁচট খেয়ে
কেবল নিজের ইচ্ছে-বলে
কম্পিত পায়ে ন্যুব্জ দেহে
সংসার ভার বইছে চলে

ছবির ফ্রেমে রয়েছে বাঁধা
নাতি নাতনি বৌমা খোকা
ড্রইংরুমের সাইড টেবিলে
একলা ভেবে খেও না ধোকা


বিশাল বাড়ির একটি কোনে
টিমটিমিয়ে জ্বলছে বাতি
নিস্তব্ধ - - - নিঃশব্দ
অশীতি এই দুজন সাথী

চুং চ্যাং কাহিনি















চুং ও চ্যাং, প্রেমী খাঁটি
থাকে তারা বাগুইহাটি
কথা কয় চোস্ত বাংলায়।
ভাবে চ্যাং করি বিয়ে
থাকে চুং পড়া নিয়ে
এখনই কী শাদি করা যায়?
চুং পেয়ে জলপানি
চ্যাঙ্গের বাধা না মানি
রাজধানি এসে পৌছায়।
চ্যাং অভিমানে দাড়ি
লম্বা করিয়া, হাঁড়ি
মুখে, পাড়া চসিয়া বেড়ায়।
চুং এরও দুখের কথা
শুনিলে বাজিবে ব্যথা
বুকে চোখ ভাসিবে ধারায়।
দিল্লীর হাটে গিয়ে
খুশি মনে “সুশী” খেয়ে
চুং দেখে সহসা দাঁড়ায়ে
স্বর্গে সে ,কেন ছাই?
সুশী ছিল পচা তাই
ঈশ্বর হেসে দেন রায়।
আসে পরী হাতে ধরি
নিয়ে যায় যেথা হরি
চোখ মুদি বাঁশরি বাজায়।
ওদিকে এ সংবাদ
শুনে চ্যাং উন্মাদ
চক্ষু রাঙ্গায়ে চিল্লায়-
বজ্জাত পাজি মেয়ে
দিল্লীর সুশী খেয়ে
আমারে ছেড়ে এ বরষায়,
পালালি কোথা, কী জানি!
চীনা হয়েও জাপানী
সুশী খেলি,কোন ভরসায়?
রাজধানী ভরা নামি
কত রেস্তোঁরা দামী
চাউমিন খেতে লাগে গায়?
আয় ফিরে শিগিগর
পারিনা থাকিতে স্থির
ভাবি,খুন করে গঙ্গায়,
ভাসিয়ে দি চুং তোরে
না এলে এখুনি ওরে
ঘুষ দিয়ে যমের ব্যাটায়।
চ্যাং এর শাসানি শুনে
চুং শুয়ে ফুলবনে
ভাবে ফেরার আছে কী উপায়?
যদি বা সে ঘরে ফেরে
কায়া তো থাকিবে না রে
চ্যাং যদি তাহারে ডরায়!
না,তা কী করিয়া হয়
প্রেমেরই হইবে জয়
চ্যাং ঠিকই চাহিবে আমায়।
চুং এটা করে স্থির
অশরীরী স্বীয় শরীর
ফুটা দিয়া গলায় পালায়।
তারপরে ভেসে ভেসে
চুং আসে যেথা মেসে
কেঁদে চ্যাং চক্ষু ভাসায়।
ফিস ফিস করে কয়
কাঁদ কেন আর নয়
একা তুমি-দেখ কে দাঁড়ায়ে?
শুনে চ্যাং মোছে চোখ
ভুলে তার সব শোক
উল্লাসে দু বাহু বাড়ায়ে।
করিয়া চুঙ্গেরে মাফ
দেয় সে বিশাল লাফ
যায় তাকে ধরিতে জড়ায়।
কিন্তু এ হল কী?
সশব্দে সে দেখি
দেওয়ালেতে গিয়া আঁছড়ায়।
মাথাটি ফুলিয়া ঢোল
দ্যাখে চোখ করি গোল
চুং যায় হাওয়াতে মিলায়।
বোঝে আজ চ্যাং ভাই
তাহারে ডাকিতে নাই
একবার “ওপারে” যে যায়।

যুগ বদল



বলি কী!যে যুগে যা সাজে,
হয়তো সে ভালো, কিম্বা বাজে!
এ আমার নিজস্য মতামত,
দেখছি ও শুনছি যা এযাবৎ !

এ যুগের এই যুব সমাজ,
দিলটা এদের বড়ই দরাজ।
প্রেমিক হয়েই থাকবে সাথে,
যে যার মতে, স্পেস রেখে তাতে।

হয়নি বিয়ে? কী বা এসে যায়,
ঝগড়া হলেই আপদ বিদায়!
দু চার জনকে না করে পরখ
বিয়ের মন্ডপে যাবার নেই শখ।

যদি বা তারা করলো বিয়ে
অতি মুশকিলে ছুটি জুগিয়ে,
বাচ্চা কাচ্চা চায় না তো ওরা,
হাম তিন নয়, বেঁচে থাকুক জোড়া।

বাড়ি গাড়ি আর অঢেল টাকা,
এম্বিসনের দৌড়াবে চাকা।
সাধ না পুরালে পঞ্চাশ নিচে,
জীবন দৌড়ে থাকবে যে পিছে।

যাক গে! কেন ভেবে মরি বল?
যুব সমাজের যুক্তি সবল।
তোমরাও তো বদলেছো, না কি?
বদলাই আমরা যা ছিল বাকি।