Tuesday, November 27, 2007

যাযাবর


আমাকে বলা হয়েছে “যাযাবর” বিষয়টি নিয়ে গল্প লিখতে।যাযাবরের সঞা ছাড়া আর কিছুই যে মাথায় আসছে না! ভগবানের দেওয়া বুদ্ধি নামক জিনিষটিকে নানান দিশায় দৌড় করিয়েও কোনও লক্ষে পৌঁছাতে পারছি না, কেবল কলম চিবিয়ে যাচ্ছি।

বলাই বাহুল্য, ভাবনার জট খুলতে গিয়ে বার বার গৃহকর্মের নৈপূণ্যে বাঁধা পড়ছে। ব্যাঞ্জনগুলি হয় আলুনি নয় অতিলুনি হয়ে পরিবেষিত হচ্ছে। আমার অসামান্য ধৈর্য্যশীল স্বামী বিনা বাক্যব্যায়ে এই অত্যাচার সহ্য করে চলেছেন।

আমি ঠিক করেছি, চুলোয় যাক যাযাবর! আজ কষিয়ে পোলাউ মাংস রান্না কোরে এ কদিনের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবো। বাজার থেকে মাংস আনার অনুরোধ শুনে উনি এমন ভাবে ভুরুজোড়া নাচালেন যে আমি গেলাম বেজায় ক্ষেপে।বললাম,”আজ নুন বেশী হবে না, হলুদ দিতে ভুলবো না, অন্যমনষ্ক হয়ে দুবার জল ঢেলে ফেলবো না।“উনি একটা ছোট্ট “আমি কী তাই বোলেছি”গোছের মুচকি হেঁসে থলিটা নিয়ে প্রস্থান করলেন।

বেশ মন দিয়ে মাংসটা কষছি, এমন সময় কে যেন বলে উঠল,”তুমি কে?”নিশ্চই সেই “অন্তরাত্মা বেটা”; আমি লক্ষ করেছি, যখনই আমি একান্তে কিছু করতে চাই, বেটা খোঁচা দেবেই দেবে।আবার আওয়াজ এল,”তুমি কে?”আমিও বা কিসে কম যাই? খুন্তিটা তালে তালে নাড়াতে নাড়াতে গান ধরলাম...”আমি এক যাযাবর; পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর, তাই আমি যাযাবর”।

খুন্তি নাড়া থেমে গেল, গানের সুর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সে ফিস ফিস করে বলে উঠলো,”মিছেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলে, পেলে তো যাযাবরকে?” মনটা ছুট্টে চলে গেল আমার সেই ১০ বছর বয়সে, যখন থেকে আমার “যাযাবরের” জীবন শুরু......

বাবার বদলির চাকরি।৩ বছর অন্তর এক শহর থেকে অন্য শহর। ট্রাকে সংসার চাপিয়ে দিয়ে ট্রেনে করে অন্য এক শহরে পৌঁছে যাওয়া। ভিন্ন লোকের সাথে মেশা, তাদের ভাষা শেখার চেষ্টা, তাদের সংষ্কৃতির কিছুটা গ্রহণ কিছুটা অবঞা। কোথাও পাহাড়ের ফাঁকে সূর্য্যাস্ত, পাহাড়ী নদীতে পা ডুবিয়ে রবিন্দ্রসংগীত গাওয়া, ফেউয়ের ডাক,পাড়ায়ে পথ হারিয়ে ফেলা ভাঘের ছানাদের খেলা। কখনও বা সমূদ্রে তটে বসে ঢেউ গোনা, অচীন ভাষা শেখার আপ্রাণ চেষ্টা, তাদের নাচ
দেখে অনুপ্রেরিতো হওয়া। কিম্বা, পড়সীর কাছে শেখা ইডলি, দোসা রান্না কোরে মায়ের তাক লাগিয়ে দেওয়া!




যাযাবরের মতই রঙ্গিন লাগতো জীবনটাকে। একই জায়গায় বছরের পর বছর কাটানোর একঘেয়েমি নেই, নতুন বন্ধুত্বের হাতছানি, নতুন রূপে নতুন দেশ দেখার নেশা, এই সবই আমার ব্যক্তিত্ত্বকে, আমার চিন্তাশক্তিকে নতুনভাবে অনুপ্রেরণা দিতো। দু বছর কাটতে না কাটতেই বাবাকে তাড়া দিতাম, জানতে চাইতাম, এবার কোথায়?

প্রকৃতির নিয়মেই হয়তো, “যাযাবর দুহিতা” একদিন “যাযাবর ভার্য্যা”হয়ে গেলেন। বাবার হাত ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। এই যাত্রায় পেলাম রাজস্থানের “ঘুমার নাচের” সাথে মুখরোচক “দাল বাটি চুর্মা”, গুজরাটের “ডাণ্ডিয়ার” সাথে“পাত্রার”স্বাদ। কেবল ভারতবর্ষ নয়, পৃথবীর ডাকে সাড়া দিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম সংসার গুটিয়ে, কাটিয়ে দিলাম দীর্ঘ ৩০ বছর বিদেশের বিভিন্ন শহরে। শিখলাম তাদের ভাষা, গ্রহণ করলাম তাদের সংষ্কৃতীর ভাল অংশটুকু।

আমাদের পরের প্রজন্মদের আমি উপাধি দিয়েছি “খান্দানী যাযাবর”। যাযাবরের রক্ত বংশানুক্রমে এখন তাদের ধমনীতে বইছে। এরা হয়তো প্রকৃত যাযাবরের মতই “ভুলবে নিজের ঘর”!সমস্ত পৃথিবী যাদের ঘর, ভারতবর্ষের মানচিত্রে, পশ্চিমবাংলার একটা ছোট্ট গ্রামের কথা তাদের কী আর মনে থাকবে?

আমরা কিন্তু ভুলতে পারিনি। জীবনের এতগুলো বছর ভবঘুরে হয়েও, শেষ অধ্যায় পৌঁছে, শিকড়ের টানে এসে থিতু হয়েছি এই গ্রাম বাংলায়।

হঠাৎ পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। গল্প লেখার মশলা যোগাড় করতে গিয়ে দেখি মাংসের মশলা পুড়ে ছাড়খাড়।


2 comments:

moumitachowdhury said...

তোমার লেখা কবিতা অনেকগুলো পরেছি। এতো ভালো গদ্য লেখারও হাত তোমার? আমি অভিভূত,তোমার ভাষা এতো সবলিন যে মন ছুঁয়ে যায়।

Sharmila Dasgupta said...

ভাবতে ভারি ভালো লাগছে যে আমার লেখা তোমার মন ছুঁইয়ে গেছে।আশাকরি ভবিষ্যতে আরও ভালো লিখতে পারবো