Tuesday, November 27, 2007

নানা রঙের বৃষ্টি


সাদা

মুখার্জি বাড়ির ৬ বছরের রাজর্ষি, ওরফে ঋষি, তাদের বিশাল বাড়ির ততোধিক বিশাল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঘন কালো মেঘের ফাঁকে বিদ্যুতের চমক দেখতে দেখতে, তার সুন্দর কচি মুখখানাতেও একটুকরো নির্মল হাসির ঝিলিক খেলে গেলো। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া আসন্ন বৃষ্টির বার্তা বয়ে আনলো। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হতেই সে দৌড়ে নিচে নামতে নামতে বলল,”মা, আমি বৃষ্টিতে ভিজবো, খুব মজা হবে”।

মণিকা রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এসে ছেলেকে আটকানোর চেষ্টা করলেন। অনেক কাকুতি মিনতি করে বললেন,” বৃষ্টিতে ভিজিস না বাবা, জ্বর হয়ে যেতে পারে, জ্বর হলে ইস্কুল কামাই হবে, বিচ্ছিরি বার্লি খেতে হবে, খেলতেও পারবি না”। যখন দেখলেন নাছোড়বান্দা ছেলেকে কিছুতেই মানানো যাচ্ছে না, তখন শোবার ঘর থেকে একখানা বড় মাপের টার্কিশ তোয়ালে আর একজোড়া জামা প্যান্ট নিয়ে ওর পিছন পিছন ছুটলেন।

প্রচন্ড গরমের পর প্রথম বৃষ্টির স্নিগ্ধ ধারায় ভিজতে ভিজতে ঋষি হাততালি দিয়ে নাচতে লাগলো। উল্লাসে চিৎকার করতে করতে হাতদুটো প্রজাপতির মত মেলে দিয়ে বাগানে এ গাছ থেকে ও গাছ ছুটে বেড়ালো। প্রবল বর্ষন যখন ওর জামাকাপড় সপসপে ভিজিয়ে তুললো, মণিকা অনেক বুঝিয়ে ছেলেকে ঢাকা বারান্দায় নিয়ে এলেন। বৃষ্টিতে তাঁরও ভিজতে খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ছেলের কথা ভেবে ইচ্ছেটাকে দমন করে নিলেন। উনি ভিজলে ছেলেকে কিছুতেই থামানো যাবে না। তারপর যদি অসুখ বাঁধিয়ে বসে! একমাত্র পুত্রের চিন্তায় উনি সর্ব্বদা তটস্থ হয়ে থাকেন।

জামা ছাড়িয়ে, নরম তোয়ালেতে ঋষির গা মুছতে মুছতে মণিকা গেয়ে উঠলেন --- পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন নেচে ওঠে ---। ঋষিও তার কচি সুরেলা গলায় মায়ের সাথে যোগ দিলো। শুকনো জামা পরে ঋষি ভিতর থেকে কাগজ জোগাড় করে নিয়ে এল। মা ছেলেতে মিলে কত যে নৌকো বানানো হোল আর সিড়ির নিচে জমে থাকা জলে ভাসানো হোল তার হিসেব নেই। বৃষ্টির ধারার সাথে এক নির্মল আনন্দের ধারা দুজনকে সিক্ত করে তুললো।

চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎ আর কাছাকাছি কোথাও প্রচন্ড জোরে বাজ পড়ার আওয়াজ শুনে মনিকা ছেলেকে বাড়ির ভিতরে এনে দরজা বন্ধ ক্করে দিলেন। রাঁধুনিকে ডেকে বললেন খিচুড়ি রান্না করতে, তার সাথে কুরকুরে আলু ভাজা আর ডিম ভাজা, ঋষি বাবুর বড় প্রিয়।


কালো

পচা ফুটপাতে থাকে। ওর বাবা মা কোথায় থাকে, বা আদৌ আছে কিনা ওর জানা নেই। বয়স বছর আষ্টেক হবে, দেখতে আরও ছোট লাগে। কালু নামের ঘেয়ো কুকুরটা পচার সর্ব্বক্ষনের সঙ্গি। পচা, ওরই মত আরও গুটিকতক ছেলে মেয়েদের সাথে সারাদিন কাগজ কুড়োয়, আর দিনের শেষে সেগুলো বিক্কিরি করে। তাতে অবশ্য দু বেলা পেট পুরে খাবার মত কিছুই জোটে না। মোড়ের চায়ের দোকানের হাবু মাঝে মধ্যে দু একখানা নেড়ি বিস্কুট খেতে দেয় তাকে। কখনও সে মন্দিরের সামনে লাইনে বসে পড়ে মানত উজ্জাপনের খাবার খেতে। কালু, পচার সঙ্গ কখনও ছাড়ে না। পচার যা জোটে, কালুও তার ভাগ অবশ্যই পায়।

উপচে পড়া ডাস্টবিন থেকে কাগজের টুকড়ো কুড়োতে কুড়োতে পচা আকাশের দিকে চাইলো। ঘন কালো মেঘের ফাঁকে বিদ্যুতের ঝিলিক তার রোদে পোড়া নোংরা মুখে একটুকরো হাসির আভাস এনে দিল। প্রচন্ড গরমের পর বৃষ্টি নামছে, একটু ঠান্ডা হবে। পরক্ষনেই সে দৃষ্টি নামিয়ে ক্ষিপ্র হাতে কাগজ বাছাইয়ের কাজে মন দিলো। বৃষ্টি নামার আগে যতটা পারে সংগ্রহ করে নিতে হবে।

দেখতে দেখতে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো। পচা বস্তাটা পিঠে নিয়ে ছুট্টে গিয়ে একটা দোকানের ছাউনির তলায় আশ্রয় নিলো। কিন্তু ওর আট বছরের চঞ্চল মন চাইছে বৃষ্টিতে ভিজতে, খুব ভিজতে। বস্তাটা সেখানেই নামিয়ে, এক ছুট্টে রাস্তায় নেমে মুখটা আকাশের দিকে তুলে প্রথমে কিছুক্ষন অঝর ধারার নিচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর শুরু হোল তার উদ্দাম নাচ। হাত দুটো ছড়িয়ে দিয়ে এ ফুটপাত থেকে ও ফুটপাত, যেন এক খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া পাখি। নাচের সাথে চলতে লগলো ঊচ্চস্বরে হিন্দি ছবির গান। তাকে দেখে আশ্রয় নেওয়া পথচারিদের মুখেও তাদের অজান্তে হাসি ফুটে উঠলো।


পচা বৃষ্টিতে ভিজেই চলেছে, তাকে যে মানা করার কেউ নেই! নেই বললেই কী চলে? হঠাৎ তার চোখে পড়ে, কাগজে ভরা বস্তাটা লোকের পায় পায় রাস্তায় পড়ে গেছে। কাগজগুলো কাদাজলে মাখামাখি। আজ আর রোজগারের কোনও আশা রইলো না! কথাটা খেয়াল হতেই শীতটা টের পেলো পচা। ভিজে শরিরটা তির তির করে কাঁপতে লাগলো। ছাউনির নিচে ফিরে এসে, কালুকে জড়িয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ভিজে হাওয়ায় তার শরীরের জল শুকোবে। আজ যে ওর কাছে এক পয়সাও নেই; যদি চায়ের দোকানের হাবু তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে চলে যায়? কথাটা ভাবতেই পেটের ভিতর ক্ষিদেটা মোচর দিয়ে উঠলো। বৃষ্টি দেখে এখন সে আর হাসছে না। আট বছরের কচি মুখে বেমানান চিন্তার রেখা। কালুকে জড়িয়ে ধরে শুকনো মুখে শুধু বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষা করছে।


রানু




বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের জটলার ফাঁক দিয়ে একফালি সূর্য উঁকি দিচ্ছে। কিছুটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া আকাশে অর্দ্ধবৃত্ত্বাকার এক রামধনু, যেন স্বয়ং ঈশ্বর তাঁর সপ্তরঙ্গা রথে চড়ে মর্তবাসিদের কাছে প্রকট হয়েছেন।

ঋষি তাদের প্রশস্ত ছাদে উঠে এসেছে রামধনু দেখবে বলে। মা, ঠাকুমা দুদিক থেকে জড়িয়ে আছেন ওকে। সে তার সুন্দর চোখদুটো আরও বড় করে অবাক বিস্ময়ে রামধনুর অত্যাশ্চর্য্য রূপ দেখছে। মা তাকে রামধনুর সাতটি রঙের বর্ণনা দিচ্ছেন আর ঠাকুমা শোনাচ্ছেন রামধনু নিয়ে রুপকথার গল্প। ওর কচি মনটা উড়তে উড়তে হারিয়ে গেল মেঘের ফাঁকে রামধনুর ওই রঙ্গেদের মাঝে।

পচা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, অবাক বিস্ময়ে রামধনুর দিকে চেয়ে আছে। আকাশে এমন অদ্ভুত সুন্দর রঙের খেলা সে আগে কোনদিনও দেখে নি। ওর কচি মনটা ক্ষিদে তেষ্টা ভুলে উড়তে উড়তে হারিয়ে গেল রামধনুর ওই রঙ্গেদের দেশে। পায়ের সাথে লেপ্টে থাকা কালুকে বললো,”এই কালু, তাকিয়ে দেখ, কী সুন্দর! ওটা কী রে?”উত্তরে কালু তার ঘেয়ো কানটা সজোরে চুলকাতে লাগলো।

রামধনু, তার সাতটা রঙের ছটা ঋষি আর পচার চোখে ছড়িয়ে দিল। ওরা দুজনেই স্বপ্ন দেখবে, সাদা কালোয়ে নয়...রঙ্গিন, সাত রঙ্গে রাঙ্গা।

2 comments:

moumitachowdhury said...

তোমার লেখা পড়ে চোখে জল এসে গেল। ভীষন সুনদর লিখেছো। বৃষিট নিয়ে এমন লেখা আমি আগে পড়িনি। তোমার লেখা অন্যদের প্রেরণা জাগায়। আরো আরো লেখা চাই।

মৌমিতা

Sharmila Dasgupta said...

মৌমিতা, অনেক ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্য এবং তাই নিয়ে দু ছত্র লেখার জন্য।